মো. সাইফুল ইসলাম

মো. সাইফুল ইসলাম

কারখানার শ্রমিক

৫ই আগস্ট, ২০২৪

ডেটা যাচাই করা হয়েছে
বয়সঃ৩৬
জন্ম তারিখঃতথ্য অনুপস্থিত
জন্মস্থানঃবাহেরচর, মেহেন্দিগঞ্জ, বরিশাল
যেভাবে শহীদ হয়েছেনঃপুলিশের গুলিতে নিহত।
জীবনীঃবৈষম্যমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখতেন সাইফুল, যেখানে তার ছেলে সেনা কর্মকর্তা হবে, আর মেয়ে হবে ডাক্তার। সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করতেন তিনি এবং প্রায়ই অংশ নিতেন মিছিলে, প্রতিবাদ-বিক্ষোভে। কিন্তু সেই স্বপ্নের কুঁড়ি দল মেলার আগেই শহীদের খাতায় নাম লেখালেন তিনি। বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার নদীভাঙন কবলিত বাহেরচর গ্রামে দরিদ্র এক পরিবারে জন্ম নেওয়া শহীদ মো. সাইফুল ইসলাম (৩৬) প্রায় ১৮ বছর ধরে ঢাকা মহানগরীর সদরঘাট এলাকার গেটওয়াল মার্কেটের একটি কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাপড় ইস্ত্রির কাজ করতেন। সম্প্রতি বাসস-এর সঙ্গে আলাপকালে রানী বলেন, গত ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে খাওয়ার পর সাইফুল তাকে ফোন করে জানান যে ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা’ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তিনি তখন উচ্ছ্বসিত হয়ে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। রানী বলেন, ‘আমি বারবার সাইফুলকে সাবধান থাকতে বলেছিলাম এবং দ্রুত কারখানায় ফিরে যেতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি বললেন, ‘আজ আনন্দের দিন, চিন্তা করো না, কিছু হবে না।’ কিন্তু সেই বিজয় মিছিলেই বংশাল থানার সামনে পুলিশের গুলিতে সাইফুল মাথায় গুরুতর আহত হন। পরে তার সহকর্মীরা খবর দিলে তার ভাই মিরাজ ও গিয়াস ঘটনাস্থলে যান এবং বিকেল ৪টা ৪৩ মিনিটে তাকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড হাসপাতাল) নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকেরা বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে সাইফুলকে মৃত ঘোষণা করেন। রানী বলেন, ‘সাইফুল বৈষম্যমুক্ত সমাজ চেয়েছিলেন। সেই কারণেই তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করতেন এবং প্রায়ই প্রতিবাদ মিছিলে অংশগ্রহণ করতেন।’ রানী আরও বলেন, সাইফুলের সঙ্গে তার পারিবারিক জীবন খুবই সুখের ছিল। তিনি ছিলেন একজন ভালো মানুষ, ভালো স্বামী ও ভালো বাবা এবং একই সাথে একজন দায়িত্ববান সন্তান। জুলাইয়ের শেষের দিকে বিহারী গ্রামে নতুন বাড়িতে ওঠার পর সাইফুল পুনরায় ঢাকায় তার কাজে ফিরে যান। প্রতিদিন সময় পেলেই তিনি রানীর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতেন। এর একমাত্র ছেলে রিশাদকে সেনা কর্মকর্তা এবং একমাত্র মেয়ে ছামিয়াকে চিকিৎসক বানানোর স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল শহীদ মো. সাইফুল ইসলামের। সাইফুলের বাবা মো. শহীদুল ইসলাম (৬০) একটি ছোট চায়ের দোকান করে এবং কোনো রকমে তার প্রতিবন্ধী স্ত্রী, চার ছেলে ও একমাত্র মেয়ের সংসার চালাতেন। চার ভাই ও একমাত্র বোনের মধ্যে সাইফুল ছিলেন সবার বড়। তার মা হোসনে আরা বেগম (৫৫) প্রতিবন্ধী হওয়ায় কোনো কাজ করতে পারেন না। শহীদ সাইফুলের এক ভাই, মিজানুর রহমান (৩২), এক বছর আগে ক্যান্সারে মারা যান। অন্য দুই ভাই- মিরাজ (৩০) ও গিয়াস (২৫) যথাক্রমে ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় দর্জির কাজ এবং গেটওয়াল মার্কেটে শ্রমিকের কাজ করেন। একমাত্র বোন মুক্তা (২২)-এর বিয়ে হয়েছে ভোলা জেলার একজন অটোরিকশাচালক শামসুদ্দিন (২৫)-এর সঙ্গে। ছোটবেলা থেকেই সাইফুল চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হন। ২০০৫ সালে তিনি ভাগ্যের সন্ধানে ঢাকায় চলে যান এবং সদরঘাট এলাকার গেটওয়াল মার্কেটের একটি কারখানায় কাপড় ইস্ত্রির কাজ নেন। কিছুদিন পর তিনি তার বাবা-মায়ের কাছে টাকা পাঠাতে শুরু করেন। দারিদ্র্যের কারণে ছোট ভাই মিরাজ ও গিয়াসও পর পর ঢাকায় চলে যান। মিরাজ একটি পোশাক কারখানায় দর্জির কাজ নেন। আর গিয়াস গেটওয়াল মার্কেটের একই কারখানায় সাইফুলের সঙ্গে কাপড় ইস্ত্রির কাজ নেন। সাপ্তাহিক ছুটি ও অন্যান্য কিছু সময় সাইফুল সূত্রাপুর এলাকার একটি হোটেলে নাশতা ও দুপুরের খাবার খেতেন। সেখানেই হোটেল মালিক এবং তার রংপুরের পীরগাছা উপজেলার বাসিন্দা স্ত্রীর সঙ্গে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০০৮ সালে হোটেল মালিকের স্ত্রী পীরগাছা উপজেলার কল্যাণী ইউনিয়নের বিহারী গ্রামের মৃত এশাহাক মিয়ার মেয়ে রানী বেগমের সঙ্গে সাইফুলের বিয়ে ঠিক করেন। সাইফুল-রানী দম্পতি ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। এর মধ্যে ২০১০ সালে তাদের ছেলে রিশাদ মিয়া এবং ২০১৩ সালে মেয়ে ছামিয়া আক্তারের জন্ম হয়। ছেলে রিশাদ এখন রংপুরের পীরগাছা উপজেলার বিহারী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে এবং মেয়ে ছামিয়া পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে। ২০১৫ সালে সাইফুল রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় স্ত্রী রানীর জন্মস্থান বিহারী গ্রামে পাঁচ শতাংশ জমি কিনেন। সম্প্রতি তিনি পরিবারের স্থায়ী বসবাসের জন্য সেখানে একটি নতুন বাড়ি তৈরি করেন এবং তার শাহাদাতের মাত্র ১০ দিন আগে নিজেই সেটির উদ্বোধন করেন। রানী বলেন, ‘আমার স্বামী শহীদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। তার স্বপ্ন ছিল ছেলে সেনা কর্মকর্তা ও মেয়ে চিকিৎসক হবে। এখন আমি কী করব?’ সাইফুলের মরদেহ ঢাকা থেকে রংপুর নেওয়ার জন্য কোনো অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত পরিবারের লোকজন বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর গ্রামে মরদেহ নিয়ে যান। পরদিন ৬ আগস্ট সকাল ১১টা ৩০ মিনিটে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সর্বশেষ পরিবর্তন:
মো. সাইফুল ইসলাম এর তথ্যে কোনো অসঙ্গতি পেয়েছেন?
অথবা আরো তথ্য যুক্ত করতে চান?মো. সাইফুল ইসলাম এর তথ্য দিন