যেভাবে শহীদ হয়েছেনঃ১৮ জুলাই চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন চবির ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হৃদয়। চার দিন আইসিইউতে থাকার পর গত ২৩ জুলাই (মঙ্গলবার) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, গুলিতে হৃদয়ের ফুসফুস ফুটো হয়ে গিয়েছিল।
হৃদয়ের বাড়ি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলায়। তাঁর বাবা রতন চন্দ্র তরুয়া, মা অর্চনা রানী। হৃদয়ের বড় বোন মিতু রানীর বিয়ে হয়েছে। মির্জাগঞ্জে হলেও পটুয়াখালীর সদরে নতুন বাজার এলাকায় ভাড়া থাকে হৃদয়ের পরিবার।
তরুয়ার বাবা কাঠমিস্ত্রি। মা হার্টের রোগী হয়েও বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। নিজেদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের টাকায় এ দম্পতি মানুষ করতে চেয়েছিলেন একমাত্র ছেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়াকে। ছেলেও চেয়েছিলেন একদিন মা-বাবার সব কষ্ট দূর করবেন। তাঁদের মুখে হাসি ফোটাবেন। ফোন করলেই তাঁদের সেই স্বপ্নের কথা বলতেন; কিন্তু একটি বুলেট সব শেষ করে দিল।
জীবনীঃআমি হৃদয় চন্দ্র তরুয়া। পিতা রতন তরুয়া। মাতা অর্চনা রানী। আমার বাবা একজন নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ। তিনিই আমাদের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। আমার বাবা পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। অন্যের দোকানে দৈনিক বেতনে কাজ করেন। সেখান থেকে যা পান, তা দিয়েই আমাদের পরিবারের ভরণপোষণ চলে।
আমার বাবার মাসিক আয় গড়ে ১২ হাজার টাকার মতো। এই টাকায় পটুয়াখালীর মতো একটা জেলা শহরে ভাড়া থাকা, খাওয়াদাওয়া, আমার লেখাপড়ার খরচ ইত্যাদি চলে। আমি এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়ি। অনেকের কাছে এটা সামান্য কিছু হলেও আমার কাছে, আমার পরিবারের কাছে অনেক।
বিদ্যালয়ে বা কলেজে পড়াকালীন সময়ে আমার পড়ালেখার খরচ বাবা মোটামুটি কষ্ট হলেও চালিয়ে নিতে পারতেন, কারণ তখন বাসায় থেকে পড়াশোনা করতাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর থেকে আমার থাকা, খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার টাকা খরচ হয়। তাই আমার এই খরচের টাকার জোগাতে আমার বাবার বেশ কষ্ট করতে হচ্ছে। তা ছাড়া আমার বাবার বয়সও বেড়েছে। যার কারণে এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। তার ওপর বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সব মিলিয়ে আমার বাবার পক্ষে পরিবারের সকল ভরণপোষণ, পাশাপাশি আমার লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার বাবার পৈতৃক সম্পত্তিও নেই বা কোনো স্থায়ী সম্পদ বাড়ি, কৃষিজমি বা কোনো অর্থও জমা নেই, যা দিয়ে এই প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
আমি নিজ থেকে কিছু আয়ের চেষ্টা চালাচ্ছি, যেমন টিউশনি। কিন্তু চট্টগ্রাম আমার জন্য নতুন শহর। এখানকার কোনো মানুষও আমার পরিচিত না। যার কারণে টিউশনি পাওয়াটা আমার পক্ষে দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম থেকে ২৩-২৫ কিলোমিটার দূরে। শাটল ট্রেনে শহরে যেতে ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট লাগে। শহর অনেক দূরে হওয়ায় টিউশনি খোঁজাটাও সময় ও কষ্টসাধ্য। তার ওপরে চট্টগ্রামে টিউশনি নিয়েও ব্যবসা চলে। কারও বা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে টিউশনি পেতে হলে একটা বড় পরিমাণের টাকা তাদের দিতে হয়। যেটা আমার মতো নিম্নবিত্ত পরিবারের স্টুডেন্টের জন্য একটু বেশিই কষ্টের। তাই এমন অবস্থায় আমি যদি কোনো প্রকার বৃত্তি পেতে পারি, সেটা আমার পরিবার ও আমার লেখাপড়ার জন্য সুবিধার হবে।
- এভাবেই নিজের সম্পর্কে ডায়েরিতে লিখেছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়া।